শমীক সরকার
বছর তিরিশের এডওয়ার্ড স্নোডেন নামে এক মার্কিন যুবক সম্প্রতি আন্তর্জাতিক মিডিয়ার শিরোনামে। কিন্তু তার শিরোনামে আসার কথা ছিল না। সে মার্কিন গুপ্তচর সংস্থা সিআইএ-র এক চুক্তিভিত্তিক কর্মচারী হওয়ার সুবাদে মার্কিন রাষ্ট্রের কিছু গোপন নথির হদিশ জেনেছিল। মার্কিন রাষ্ট্রের গুপ্তচর বৃত্তির কাজে শিক্ষানবিশী যারা করে, তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য বানানো কিছু স্লাইড (ইলেকট্রনিক পোস্টার) সেই গোপন নথি। স্নোডেন সেগুলি ফাঁস করে দেয় আমেরিকার নিউইয়র্ক টাইমস এবং ব্রিটেনের গার্ডিয়ান নামে দুটি বিরাট পত্রিকাগোষ্ঠীর দুই সাংবাদিকের কাছে। সেই পত্রিকাদুটি ওই স্লাইডের কয়েকটি মাত্র তাদের ওয়েবসাইট ও প্রিন্ট সংবাদপত্রে প্রকাশ করে। তাতে দেখা যায়, মাইক্রোসফট থেকে গুগল, ইয়াহু থেকে ফেসবুক — ইন্টারনেটের দুনিয়ার রাঘব বোয়াল কর্পোরেটদের প্রত্যেকটির কেন্দ্রীয় মহাফেজখানা বা সার্ভারে মার্কিন রাষ্ট্র যন্ত্র বসিয়ে রেখেছে। ফলে সারা পৃথিবীর ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের মধ্যে যারা ওই কর্পোরেট কোম্পানিগুলির ওয়েবসাইট ব্যবহার করে তাদের সমস্ত ব্যক্তিগত তথ্যাদি, তারা কোন কোন ওয়েবসাইট দেখেছে, কী কী টাইপ করেছে ইন্টারনেটে, কাদের কী কী ইমেল করেছে, ফেসবুকে কী কী স্ট্যাটাস দিয়েছে বা কমেন্ট করেছে বা কার কার প্রোফাইল দেখেছে — অর্থাৎ প্রকৃত অর্থেই ইন্টারনেটে থাকাকালীন প্রতিটি মাউস ক্লিক এবং প্রতিটি কি-বোর্ড এন্ট্রি, যা জমা হয় ওই কোম্পানিগুলির মহাফেজখানায়, সব চলে গেছে মার্কিন রাষ্ট্রের হাতে। স্লাইডে নাম আছে যাদের, সেই সমস্ত কোম্পানিই আমেরিকান এবং সমস্ত কোম্পানিই তাদের সমস্ত দেশের ব্যবহারকারীর তথ্য মার্কিন দেশে মহাফেজখানায় (কতগুলি ভারী কম্পিউটার) রাখে, কারণ মার্কিন দেশে মহাফেজখানা বা সার্ভার বসানো সস্তা। ফলে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার সুবিধাই হয়েছে। যাই হোক, এসব ফাঁস হয়ে যেতে দুনিয়া জুড়ে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের মধ্যে ঢি ঢি পড়ে যায়। মার্কিন রাষ্ট্রপতি স্বীকার করে নেন, এসব করা হচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও করা হবে।
এই তথ্য প্রকাশ্যে আসার দিনকয়েকের মধ্যে স্নোডেন নিজে প্রকাশ্যে আসে। সে মিডিয়া সাক্ষাৎকারে বলে, সে হংকংয়ে আছে, সে-ই এই ফাঁস ঘটিয়েছে। হংকংয়ের যে হোটেলে সে আছে, সেখানে সে প্রায় পাগলের মতো নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছে নিজের জন্য — এমনকী সে হোটেলের দরজায় সার সার বালিশ দিয়ে রেখেছে, যাতে সে ঘরে কী করছে বা কী বলছে, বাইরে থেকে কেউ তা আড়ি পেতে দেখতে বা শুনতে না পারে। বোঝাই যায়, মার্কিন গুপ্তচর সংস্থার হাত থেকে নিজের প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে তার প্রকাশ্যে চলে আসা, যদিও এর ফলে আখেরে যে ক্ষতি হবে বিষয়টির, সে জানত। ওই সাক্ষাৎকারে স্নোডেন বলেছিল, এবার বড়ো মিডিয়া তাকে টপিক বানাবে আর তার ফাঁস করা জিনিস সরে যাবে মিডিয়া থেকে। স্নোডেনের আশঙ্কা সত্যি প্রমাণিত হয়েছে। আন্তর্জাতিক বড়ো মিডিয়া যেন ওঁৎ পেতেই ছিল। সারা পৃথিবীর সমস্ত ইন্টারনেট ব্যবহারকারী মানুষের ওপর মার্কিন রাষ্ট্রের গুপ্তচরবৃত্তির বাস্তবটি নিয়ে আলোচনা সরে গেছে মিডিয়া থেকে। বদলে স্নোডেন সংবাদের শিরোনামে। সে কোথায় যাচ্ছে? তার প্রেমিকা কে? সে কী বলছে? তার বাবা কী বলছেন? সে কোন দেশে পালিয়েছে? কোন কোন দেশের কাছে সে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছে? সেসব দেশের রাষ্ট্রপতিরা কি বলছে? — এইসব চলছে। এমনকী আমাদের বাংলা মিডিয়াতেও চলে এসেছে স্নোডেন কিস্যা। ভারত স্নোডেনকে রাজনৈতিক আশ্রয় না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এই সিদ্ধান্তের নিন্দা করেছেন দিল্লির উঠতি রাজনৈতিক নেতা অরবিন্দ কেজরিওয়াল। বামপন্থী এবং মানবাধিকার কর্মীরাও স্নোডেন নিয়ে চিন্তিত। সে চিন্তাও স্বাভাবিক।
বিস্তারিত পড়ুন →