জিল দেল্যুজ
১. ঐতিহাসিক
ফুকো অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে নিয়মানুবর্তী সমাজের উপস্থিতি চিহ্নিত করেছিলেন। বিংশ শতাব্দীর গোড়ায় সেগুলি তাদের শিখরে পৌঁছেছিল। সেগুলি এগিয়ে যাচ্ছিল বিশালাকার পরিবেষ্টনগুলির এক সংগঠনের দিকে। ব্যক্তি সেখানে অবিরত এক পরিবেষ্টন থেকে অপর একটিতে যেত, প্রতিটি পরিবেষ্টনের ছিল নিজস্ব কিছু নিয়ম : প্রথমে পরিবারে, তারপর স্কুলে (‘তুমি আর নিজের বাড়িতে নেই’), তারপর ব্যারাকে (‘তুমি আর স্কুলে নও’), তারপর কারখানায়, মাঝেমাঝে হাসপাতালে, হয়তো কখনো কারাগারে, যা নিজেই চমৎকার এক পরিবেষ্টন। কারাগারই হল পরিবেষ্টনের আদর্শ মডেল : রোসেলিনির ইউরোপা’৫১-এর নায়িকা কিছু শ্রমিককে দেখে চমকে গিয়ে বলেছিলেন, ‘আমি ভেবেছিলাম সাজাপ্রাপ্ত কিছু লোক দেখছি!’ [অনুবাদকের নোট : ১৯৫২ সালে ইতালিয়ান চলচিত্র পরিচালক রবার্তো রোসেলিনির সিনেমা ইউরোপা’৫১ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী ইউরোপের একটি চিত্রায়ণ। নায়িকা রোম শহরের এক ধনী ঘরের বউ, একমাত্র সন্তানের আকস্মিক মৃত্যুর পর সে এক কমিউনিস্ট বন্ধুর পাল্লায় পড়ে রোমের গরীব পাড়ায় যাতায়াত শুরু করে। সেই পাড়ার এক ছয় সন্তানের মা-কে একটি কারখানায় কাজ পাইয়ে দিতে গিয়ে সে প্রত্যক্ষ করে কারখানা, শ্রমিক।]
ফুকো চমৎকারভাবে পরিবেষ্টনের এই আদর্শ প্রকল্পটি ব্যাখ্যা করেছিলেন, যা বিশেষভাবে কারখানায় দেখা যায় : এক জায়গায় জড়ো করা; জায়গাটাতে ভালোভাবে ছড়িয়ে দেওয়া; সময়ে সময়ে আদেশ করা; ওই স্থান-কালে একটা উৎপাদিকা শক্তি গড়ে তোলা, যার ফলাফল তার অংশগুলির শক্তির সমষ্টির তুলনায় বেশি হয়। কিন্তু ফুকো এই প্রকল্পের সার কথাটিও জানতেন : এটা এসেছে এক সার্বভৌম সমাজের পরে, যার লক্ষ্য এবং কার্যপ্রণালী ছিল সম্পূর্ণ আলাদা (উৎপাদন সংগঠিত না করে তার ওপর কর চাপানো; জীবন কীভাবে চলবে তা ঠিক না করে মৃত্যুর আইন জারি করা)। আস্তে আস্তে এই অতিক্রমণ ঘটেছে, এবং নেপোলিয়নকেই মনে হয় এই এক সমাজ থেকে অন্য সমাজে ব্যাপক রূপান্তরের কারক। কিন্তু এই নিয়মানুবর্তিতা এবং তার প্রণালী একটা সংকটে পড়ল, যখন নয়া শক্তিগুলি জিইয়ে উঠল। এই নয়া শক্তিগুলি ক্রমান্বয়ে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছিল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তা গতি পেল : নিয়মানুবর্তী সমাজ, যেখানে আমরা খুব একটা আর ছিলামও না, সেই সমাজে আর আমরা একেবারেই থাকলাম না।
কারাগার, হাসপাতাল, কারখানা, স্কুল, পরিবার, এই সমস্ত পরিবেষ্টনগুলিতেই আমরা একটা সাধারণ সংকটে পড়লাম। পরিবার একটি ‘অন্তর্বিভাগ’, তা সংকটে ছিল, যেমন ছিল পণ্ডিতি, পেশাদারী ইত্যাদির মতো অন্য অন্তর্বিভাগগুলি। ভারপ্রাপ্ত প্রশাসনগুলি আপাত-প্রয়োজনীয় সংস্কারগুলি ঘোষণা করা থামায়নি — স্কুল সংস্কার, শিল্প সংস্কার, হাসপাতাল সংস্কার, সেনাবাহিনী সংস্কার, জেল সংস্কার। কিন্তু প্রত্যেকেই জানত, এই প্রতিষ্ঠানগুলি শেষ হয়ে আসছে, ক-দিন কম বা বেশি তাদের আয়ু। কেবল তাদের শেষকৃত্য আয়োজনের অপেক্ষা, আর দরজায় কড়া নাড়ছে যে নয়া শক্তিগুলি, সেগুলির স্থাপন না হওয়া পর্যন্ত মানুষকে নিযুক্ত করে রাখা।
এই নিয়মানুবর্তী সমাজকে প্রতিস্থাপিত করতে চলেছে নিয়ন্ত্রণী সমাজ। ‘নিয়ন্ত্রণ’ — এই নামেরই প্রস্তাব করেছিলেন বারো [অনুবাদকের নোট : উইলিয়াম বারো (১৯১৪-৯৭), মার্কিন লেখক ও কবি।], এই নয়া দানবটির জন্য, এবং ফুকো বুঝতে পেরেছিলেন তা আমাদের খুব কাছাকাছি চলে এসেছে। পল ভিরিলিও-ও [অনুবাদকের নোট : পল ভিরিলিও (১৯৩২-) ফরাসি সংস্কৃতি-তাত্ত্বিক, প্রযুক্তি, শহর প্রভৃতি বিষয়ে লেখালেখি করেন।] বিশ্লেষণ করে চলেছেন খুল্লাম-খুল্লা নিয়ন্ত্রণের অতি-দ্রুত বন্দোবস্তগুলিকে, যেগুলি প্রতিস্থাপিত করছে একটি আবদ্ধ ব্যবস্থার সময়কাল জুড়ে থাকা পুরোনো শৃঙ্খলাগুলিকে। এখানে অসাধারণ ঔষধ উৎপাদন, পারমাণবিক কারিগরি, জেনেটিক ওলটপালটের প্রয়োজন নেই, যদিও নয়া পদ্ধতিগুলির সঙ্গে জুড়ে যাওয়াই এদের নিয়তি। এখানে ঠাঁই নেই এসব প্রশ্নের, কোন জমানা সবচেয়ে টেকসই, সবচেয়ে সহনীয়। কারণ প্রতিটি জমানার মধ্যেই মুখোমুখি মুক্তি আর দাসত্বের শক্তিগুলি। উদাহরণ স্বরূপ, পরিবেষ্টন রূপে হাসপাতাল যখন সঙ্কটে পড়ল, পাড়ার ক্লিনিক, ডে-কেয়ার, নার্সিং হোমগুলি নয়া মুক্তি রূপে দেখা দিল। কিন্তু তারা সেই নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতিগুলিতেই অংশ নিল যেগুলি সবচেয়ে জবরদস্ত পরিবেষ্টনগুলির সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে। এখানে আশঙ্কার বা আশার ঠাঁই নেই, কেবল নয়া অস্ত্রশস্ত্রের খোঁজ।
২. যৌক্তিক
পরিবেষ্টনের যে ভিন্ন ভিন্ন অভ্যন্তর দিয়ে ব্যক্তি পার হয় সেগুলি স্বাধীন ভাবে পরিবর্তনশীল : প্রতিবারই শূন্য থেকে শুরু হচ্ছে বলে মনে হয়, এবং সমস্ত পরিবেষ্টনেরই একটি সাধারণ ভাষা আছে, কিন্তু তা রূপক ভাষা। যদিও এই বিভিন্ন নিয়ন্ত্রক হল অবিচ্ছেদ্য ভিন্নতা, যা তৈরি করে একটি জ্যামিতিক ভিন্নতার ব্যবস্থা, যার ভাষা হল সংখ্যা (তা আবশ্যকভাবে বাইনারি নয়)। পরিবেষ্টনগুলি স্বতন্ত্র ধাঁচার, কিন্তু নিয়ন্ত্রণগুলি একই ছাঁদের, যেন এক স্বয়ং-বিকৃত ধাঁচা যা ধারাবাহিকভাবে বদলায়, ক্ষণে ক্ষণে, অথবা জালের মতো, যার বুনোট বদলে যায় এই বিন্দু থেকে অন্য বিন্দুতে।
আমরা সেটাকে বিলক্ষণ বেতনের প্রশ্নটি দিয়ে দেখতে পাই : কারখানাটি হল একটি দেহ যা তার আভ্যন্তরীণ শক্তিগুলিকে একটি সাম্যাবস্থায় ধরে রাখে, উৎপাদনের বেলায় যতটা উঁচুতে সম্ভব, আর বেতনের বেলায় যতটা নিচুতে সম্ভব; কিন্তু একটি নিয়ন্ত্রণের সমাজে, কর্পোরেশন প্রতিস্থাপিত করছে কারখানাকে, এবং কর্পোরেশন হল একটি আত্মা, বিদেহী। কারখানায় নিঃসন্দেহে বোনাসের ব্যবস্থা ছিল, কিন্তু কর্পোরেশন কাজ করে চ্যালেঞ্জ, প্রতিযোগিতা এবং চড়া দাগের বাকবিতণ্ডার মধ্যে দিয়ে চলা এক নিরন্তর অধিস্থিতির অবস্থায় প্রতিটি বেতনে একটি নিয়মকানুন চাপিয়ে দিয়ে। সবচেয়ে বোকা টিভি গেম শো-গুলি এত সফল হয়, তার কারণ সেগুলি কর্পোরেশনের অবস্থাটি সবচেয়ে নিখুঁতভাবে তুলে ধরেছে। কারখানা ব্যক্তিদের একটি একক দেহ হিসেবে ধারণ করে, এতে দ্বিগুণ সুবিধা মালিকদের যারা জনগণের প্রতিটি অংশকে নজরে রাখে, এবং নজরে রাখে ট্রেড ইউনিয়নগুলোকেও, যারা একটা গণ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে চায়। কিন্তু কর্পোরেশন ক্ষমার অযোগ্য শত্রুতাকেই সবচেয়ে স্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতা হিসেবে নিয়ত তুলে ধরে, এবং তা চমৎকারভাবে চাগিয়ে তোলে নিজেদের মধ্যে একে অন্যের বিরুদ্ধতা, যাতে প্রত্যেকে ফালাফালা হয়ে যায়, নিজেরাই নিজেদের ভেঙে ফেলে। ‘মেধা অনুযায়ী বেতন’-এর নিয়ম এমনকী জাতীয় শিক্ষাকেও উসকাতে ছাড়ে না। ফলে, যেমনভাবে কর্পোরেশন কারখানাকে প্রতিস্থাপিত করছে, নিরন্তর প্রশিক্ষণ প্রতিস্থাপিত করতে চলেছে স্কুলকে, ধারাবাহিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিস্থাপিত করছে পরীক্ষাকে। স্কুলকে কর্পোরেশনের হাতে তুলে দেওয়ার এটাই নিশ্চিততম রাস্তা।
নিয়মানুবর্তী সমাজে আমাদের পুনরায় শুরু করা থামে না (স্কুল থেকে ব্যারাক, ব্যারাক থেকে কারখানা), আর নিয়ন্ত্রণী সমাজে আমাদের কোনো কিছুই শেষ হয় না কখনও, উদ্যোগ (কর্পোরেশন), প্রশিক্ষণ (শিক্ষাব্যবস্থা), পরিষেবা (সামরিক) সবই অধিস্থিতির অবস্থায় থাকে এবং একই ধরনের নিয়মকানুনের মধ্যে পাশাপাশি চলে, যেন বিকৃতির এক সার্বজনীন ব্যবস্থা। ‘দি ট্রায়াল’-এ কাফকা অবতারণা করেছিলেন দুই ধরনের সমাজের গাঁটছড়ার, দুটির প্রবলতম পরাক্রমী বিচারব্যবস্থার প্রক্রিয়াকে বর্ণনা করে : নিয়মানুবর্তী সমাজের আপাত নিষ্কৃতি (দুটি পরিবেষ্টনের মধ্যে), নিয়ন্ত্রণী সমাজের সীমাহীন স্থগিতাদেশ (নিরন্তর পরিবর্তনের মধ্যে), এই দুই ধরনের আইনি জীবনের বিস্তর ফারাক। এবং যদি আমাদের আইনি অধিকার ইতস্তত করে, নিজেই সঙ্কটে পড়ে যায়, তার কারণ, আমরা একটা ছেড়েছি অন্যটায় যাবার জন্য। নিয়মানুবর্তী সমাজের দুটি মেরু : স্বাক্ষর, যা ব্যক্তিকে নির্দেশ করে, এবং প্রশাসনিক সংখ্যা, যা জনতার মধ্যে তার অবস্থানকে নির্দেশ করে। সেটাই হল নিয়মানুবর্তিতা যা কখনও এই দুইয়ের মধ্যে অসামঞ্জস্য দেখে না। এবং তাতে ক্ষমতা হল একই সময়ে গণ এবং ব্যক্তিগত। অর্থাৎ যাদের নিয়ে তার দেহটি তৈরি, তাদের ওপরই তার প্রয়োগ, এবং সেইভাবেই সে তার দেহের প্রতিটি সদস্যের ব্যক্তিত্বকে তৈরি করে নেয় (ফুকো এই দ্বৈত ভূমিকার উৎসকে দেখেছিলেন যাজকের ধর্মোপদেশক ক্ষমতার মধ্যে — পশুর পালের মধ্যে প্রতিটি পশু যেমন, কিন্তু নাগরিক ক্ষমতা অন্যান্য কায়দার পাশাপাশি নিজেই নিরীহ ‘ধর্মোপদেশক’ সাজে)। বিপরীতে, নিয়ন্ত্রণী সমাজে প্রশাসনিক সংখ্যা বা স্বাক্ষর কোনোটিই অত্যাবশ্যক নয়, আবশ্যক একটি কোড : যে কোড হল একটি চলাচলের ভাষ্য [পাসওয়ার্ড], যেখানে নিয়মানুবর্তী সমাজ দাঁড়িয়ে আছে আদেশের ভাষ্যগুলির ওপর (যতটা সংহতির দৃষ্টিকোণ থেকে, ততটাই প্রতিরোধের দৃষ্টিকোণ থেকে)। নিয়ন্ত্রণের গণক ভাষা এই কোড দিয়ে তৈরি, যা বোঝায় তথ্যের গ্রহণ বা প্রত্যাখ্যান। আমরা আর সামনে দেখতে পাই না গণ-ব্যক্তি জোড়-কে। ব্যক্তি হয়ে ওঠে ‘বিভক্ত’, আর গণ হয়ে ওঠে নমুনা, ডেটা, বাজার অথবা ‘ব্যাঙ্ক’। হয়তো টাকাই সবচেয়ে ভালোভাবে প্রকাশ করে দুই সমাজের ফারাক, যেহেতু নিয়মানুবর্তিতা সর্বদা সখ্যতা করেছে ছাপানো নোটের সঙ্গে, যার মধ্যে ধরা আছে সোনার মান্য সূচক, আর নিয়ন্ত্রণ বোঝে ভাসমান বিনিময়, যার নিয়মকানুন তৈরি হয় এক সারি মান্য মুদ্রার সূচক সাপেক্ষে। বুড়ো ভাম মুদ্রা হল পরিবেষ্টনের প্রাণী, কিন্তু নিয়ন্ত্রণী সমাজে সে হয়ে ওঠে সাপ। আমরা এক জন্তু থেকে আরেক জন্তুর খপ্পরে পড়ি, ভাম থেকে সাপ, শুধু যে ব্যবস্থার মধ্যে আমরা বেঁচে থাকি তার ভেতরেই নয়, এমনকী আমাদের জীবনযাপন ও অন্যদের সঙ্গে সম্পর্কেও। নিয়মানুবর্তী মানুষ ছিল শক্তির অ-ধারাবাহিক উৎপাদক, কিন্তু নিয়ন্ত্রিত মানুষ বরং তরঙ্গায়িত, কক্ষপথে স্থাপিত, এক লাগাতার জালের ওপর। সব জায়গায় পুরোনো খেলাগুলোকে প্রতিস্থাপিত করেছে সারফিং।
প্রতিটি সমাজকে তার মেশিনগুলির ধরন দিয়ে বোঝানো সহজ, তার কারণ এটা নয় যে মেশিনগুলিই নির্ধারক। বরং তার কারণ হল, সমাজটির সামর্থ্যের যে রূপগুলি তাদের জন্ম দিয়েছে এবং যাদের তারা সেবা করছে, সেগুলিকে তারা প্রকাশ করতে পারে। পুরোনো সার্বভৌম সমাজগুলি নাড়াচাড়া করত সহজ মেশিন নিয়ে, লিভার, পুলি, ঘড়ি; কিন্তু সাম্প্রতিক নিয়মানুবর্তী সমাজগুলির ছিল শক্তিচালিত মেশিনপত্র, বিশৃঙ্খলার সুপ্ত বিপদ এবং অন্তর্ঘাতের জাগ্রত আশঙ্কা নিয়ে। নিয়ন্ত্রণী সমাজগুলি কাজ চালায় ত্রিমাত্রিক মেশিন দিয়ে, তথ্য ও গণনার মেশিন, জট পেকে যাওয়ার সুপ্ত বিপদ ও লুঠ হওয়া [পাইরেসি] এবং জীবাণু [ভাইরাস] ঢুকে পড়ার জাগ্রত বিপদ নিয়ে। পুঁজিবাদের এক ব্যাপক রূপান্তর ছাড়া প্রযুক্তিগত বিবর্তন হয় না। এই রূপান্তরটি সকলের ভালোই জানা, যার সারাংশ এইরকম : একবিংশ শতকের পুঁজিবাদ হল কেন্দ্রীভবন, উৎপাদন এবং মালিকানার পুঁজিবাদ। পুঁজিপতি হল উৎপাদনের উপকরণের মালিক, পরিবেষ্টনগুলির মধ্যে কারখানাটি হয়তো তার তৈরি, কিন্তু ঘটনাচক্রে সে অন্যান্য পরিবেষ্টনগুলিরও (শ্রমিকের বসতবাটি, স্কুল) মালিক। আর বাজার, তা কব্জা করা হয় কখনও বিশেষজ্ঞতার মাধ্যমে, কখনও উপনিবেশের মাধ্যমে, কখনও উৎপাদনের খরচ কমিয়ে। কিন্তু, বাস্তবে, পুঁজিবাদ আর উৎপাদনে নেই, উৎপাদন প্রধানত তৃতীয় দুনিয়ার প্রান্তে নির্বাসিত হয়েছে, তা সে বস্ত্র, ধাতু, বা পেট্রোলের জটিল কোনো রূপভেদ, যা-ই হোক। এ হল উপ-উৎপাদনের পুঁজিবাদ। এ আর কাঁচামাল কেনে না, বা তৈরি-মাল বিক্রিও আর করে না : এ তৈরি-মাল কেনে, আর আলাদা আলাদা অংশগুলি জোড়া লাগায়। এ বিক্রি করতে চায় পরিষেবা, কিনতে চায় স্টক। এটা আর উৎপাদনের জন্য পুঁজিবাদ নয়, পণ্যের জন্য পুঁজিবাদ, অর্থাৎ, বেচাকেনার পুঁজিবাদ। এবং এ মূলগতভাবে ছড়ানো, কারখানা জায়গা বেচে দিয়েছে কর্পোরেশনকে। পরিবার, স্কুল, আর্মি, কারখানা রূপের এক মালিকানায় বাঁধা পরিবেষ্টনগুলি আর নেই, তা সে ব্যক্তিগত মালিকানা বা রাষ্ট্রীয় মালিকানা যাই হোক না কেন। এসেছে কিছু সাংকেতিক ছবি, যেগুলি বাঁকানো বা বদলানো যায়, একই কর্পোরেশনের, যার হাতে রয়েছে কেবল স্টকহোল্ডাররা।
এমনকী শিল্পকলা তার পরিবেষ্টন ছেড়ে ব্যাঙ্কের খোলা বর্তনীতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। বাজার কব্জা করা হয়েছে নিয়মকানুনের জোরের বদলে নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে, খরচ কমানোর পরিবর্তে বিনিময় হার [এক্সচেঞ্জ রেট] স্থির করে দেওয়ার মাধ্যমে, উৎপাদনের বিশেষত্ব আনার পরিবর্তে পণ্যের রূপ বদলের মাধ্যমে। দুর্নীতি এক নয়া মাত্রা পেয়েছে এখানে। বেচার কাজটাই কর্পোরেশনের কেন্দ্রীয় কাজ তথা ‘আত্মা’ হয়ে উঠেছে। আমরা শিখেছি, কর্পোরেশনকে একটা আত্মা হিসেবে দেখতে, যা হল দুনিয়ার সবচেয়ে বড়ো আতঙ্কের খবর। বাজারই হল এখন সামাজিক নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার, এবং আমাদের প্রভুদের উদ্ধত জাতকের নির্মাতা। নিয়ন্ত্রণ হল একটি ছোট্ট কথা, এবং দ্রুত ঘুরে আসে, কিন্তু একইসাথে ধারাবাহিক ও সীমাহীন, যেখানে নিয়মানুবর্তিতা এক দীর্ঘকালীন, অসীম, এবং অধারাবাহিক ব্যাপার। মানুষ আর অন্তরীণ নয়, ঋণী। একথা সত্যি, পুঁজিবাদ মানবতার তিন চতুর্থাংশকে চরম দুর্দশায় রেখেছে, এত দরিদ্র যে ঋণও পাবে না, এত সংখ্যায় যে সবাইকে অন্তরীণও করা যাবে না। নিয়ন্ত্রণকে কেবল সীমানাগুলি উবে যাওয়ার সাথে মোকাবিলা করতে হচ্ছে তা নয়, বস্তি ও ঘেটোর বিস্ফোরণের সাথেও মোকাবিলা করতে হচ্ছে।
৩. কর্মসূচি
নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতিটা বোঝার জন্য এমন কল্পবিজ্ঞানের অভাব নেই, যা খোলা জায়গায় একটা কিছুর অবস্থান প্রতি মুহূর্তে বলে দেয়, সংরক্ষিত প্রাণীদের মতো অথবা কর্পোরেশনে মানুষের মতো (ইলেকট্রনিক কলার লাগানো আছে)। ফেলিক্স গুয়াত্তারি কল্পনা করেছিলেন এক শহরের কথা, যেখানে প্রত্যেকে ছেড়ে যেতে পারে তার অ্যাপার্টমেন্ট, তার রাস্তা, তার পাড়া, (বিভক্ত) ইলেকট্রনিক কার্ডের দৌলতে, যা তুলে দেয় এই ধরনের সীমানাগুলোকে; কিন্তু কার্ডটি এই দিনে বা দিনের এই এই ঘন্টায় বাতিলও হয়ে যেতে পারে; দরকারি বিষয়টা এই সীমানাগুলো নয়, ওই কম্পিউটারটা, যা পারে প্রত্যেকের অবস্থানকে চিহ্নিত করতে, আইনি বা বেআইনিভাবে, এবং যা এক বিশ্বব্যাপী নিয়ন্ত্রণ কাঠামো চালায়।
নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতির সামাজিক-প্রযুক্তিগত গবেষণা, যা উদীয়মান, তাকে হতে হবে কাটা কাটা এবং বর্ণনা করতে হবে সেই পদ্ধতিকে যা ইতিমধ্যেই নিয়মানুবর্তী পরিবেষ্টনগুলির জায়গা নিচ্ছে, যখন সারা দুনিয়া ঘোষণা করছে সেই পরিবেষ্টনগুলির সংকট। হতে পারে এগুলো পুরোনো কায়দা, প্রাচীন সার্বভৌম সমাজগুলি থেকে ধার করা, বর্তমানে ফেরানো হয়েছে তাদের, কিন্তু প্রয়োজনীয় রদবদল করে। যা দরকারি বিষয় তা হল, আমরা কিছুর সূচনালগ্নে রয়েছি। জেলখানা ব্যবস্থায় : অন্তত পাতি অপরাধের জন্য ‘বিকল্প’ শাস্তির খোঁজ করা হচ্ছে, আর ব্যবহার করা হচ্ছে ইলেকট্রনিক কলার যা অপরাধীকে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বাড়িতে থাকতে বাধ্য করতে পরানো হয়। স্কুল ব্যবস্থায় : নিয়ন্ত্রণের ধারা অব্যাহত, এবং স্কুলের ওপর নিরন্তর প্রশিক্ষণের কর্মসূচি চাপানো হচ্ছে, ইউনিভার্সিটির সমস্ত গবেষণা বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে, লেখাপড়ার সমস্ত স্তরে ‘কর্পোরেশন’ ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে। হাসপাতাল ব্যবস্থায় : নতুন চিকিৎসায় ‘না আছে ডাক্তার, না আছে রোগী’, তাতে সম্ভাব্য রোগী এবং ঝুঁকির বিষয়ের খোঁজ করা হচ্ছে, যাতে ব্যক্তি স্তরে চিকিৎসার দিকে কোনো অগ্রগতি নেই, যেমন লোকে বলে থাকে। কিন্তু ব্যক্তিগত ও সংখ্যাগত শরীরের জায়গা নেয় ‘বিভক্ত’ একটি পদার্থের কোড, নিয়ন্ত্রণের জন্য। কর্পোরেশন ব্যবস্থায় : টাকা, পণ্য এবং মানুষের নয়া ব্যবহার, যা মোটেই পুরোনো দিনের কারখানার মতো নয়। উদাহরণগুলো খুব ছোটো, কিন্তু ভালো বোঝা যায় যখন আমরা প্রতিষ্ঠানগুলির সঙ্কটের মাধ্যমে এসব শুনি, অর্থাৎ যখন ধীরে ধীরে বিস্তৃতভাবে নয়া দমনের জমানা প্রতিষ্ঠিত হয়। অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হল, ইউনিয়নগুলির অবান্তর হয়ে পড়া : পরিবেষ্টনের ভিতরে বা নিয়মানুবর্তিতার বিরুদ্ধে সমস্ত লড়াইয়ের ইতিহাসের সঙ্গীরা, তারা কি নিজেদের বদলে নিতে পারবে, নাকি নিয়ন্ত্রণের সমাজের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের নয়া রূপগুলিকে জায়গা ছেড়ে দেবে? আমরা কি ধরতে পেরে গেছি, আসন্ন রূপগুলোর খসড়াগুলি? যা মার্কেটিংয়ের খেলাকে আক্রমণ করতে পারে? যুব প্রজন্মের অনেকেই আশ্চর্য্যজনকভাবে দাবি করে যে তারা ‘উদ্দীপিত’, তারা পুনরায় চায় স্থায়ী কর্মসূচি এবং মঞ্চ; আমরা কীসের পেছনে ছুটব তা আমাদেরই আবিষ্কার করতে হবে, যেমন আমাদের পূর্বসূরীরা কষ্ট করে আবিষ্কার করেছিল নিয়মানুবর্তিতার অন্ত। মেঠো ইঁদুরের গর্তগুলির তুলনায় সাপের কুণ্ডলীগুলো আরও জটিল।
ল’অত্র জার্নাল (অন্য পত্রিকা), প্রথম সংখ্যা, মে ১৯৯০